কুরআন

কুরান থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি

কুরআন থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি

আল্লাহ তাআলা মানব জাতির হিদায়াতের জন্য মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করেছেন এবং কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ সকলের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে: وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ “আমি কুরআন সহজ করে দিয়েছি; আছ কেউ উপদেশ গ্রহণকারী?” (সূরা কমার: ১৭) কুরআনের উপদেশগুলো যেহেতু আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন কওমের ঘটনা এবং উদাহরণের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন সেহেতু তা বুঝা সহজ। পক্ষান্তরে আহকাম বর্ণনার ক্ষেত্রে ঘটনা এবং উদাহরণের মাধ্যম না থাকায় তা বুঝা কষ্টসাধ্য। তাই কঠিন বিষয় বোধগম্য করতে সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর রসূলকে কুরআনের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:  فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَه ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَه “যখন আমি কুরআন পাঠ করি তখন আপনি তার অনুকরণ করুন। আর এর বিশদ বর্ণনা আমারই দায়িত্বে”। (সূরা কিয়ামাহ: ১৮-১৯) আবার তাঁর প্রতি দায়িত্ব দিয়েছেন কুরআনের বাণী উম্মাতকে ব্যাখ্যা করে শুনাতে। ইরশাদ হচ্ছে: وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ “আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি যেন মানুষের জন্যে যা অবতীর্ণ হয়েছে আপনি তাদেরকে তা বুঝিয়ে দেন।” (সূরা নাহল: ৪৪) এ নির্দেশটি বিশেষভাবে আহকামের সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ পালনে রসূলুল্লাহ স. ছিলেন সদা তৎপর। তিনি সাহাবায়ে কিরামকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে কুরআন বুঝিয়েছেন এবং তাঁদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায়ের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। (বুখারী: ৬৩২৮) অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম তাবিঈদেরকে কুরআন বুঝিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের পরবর্তীদেরকে। আর এটাই কুরআন থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি। এ নিয়মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাহাবায়ে কিরাম কুরআনের ওই ব্যাখ্যাই তুলে ধরেছেন যা রসূলুল্লাহ স. থেকে শুনেছেন ও বুঝেছেন। যদিও বর্ণনার ক্ষেত্রে কখনও কখনও রসূলুল্লাহ স.-এর নাম উহ্য রেখেছেন। এ ধারাবাহিকতায় তাবিঈন, তাবে তাবিঈন ও তাঁদের পরবর্তী মুফাসসিরগণ কুরআনের কোন ব্যাখ্যা তুলে ধরার পূর্বেই বর্ণনা করে থাকেন যে, “আমি আমার উসতাদ অমুকের নিকট থেকে এ ব্যাখ্যা শুনেছি; তিনি তাঁর উসতাদ থেকে এ ব্যাখ্যা শুনেছেন”। এ নিয়ম অগ্রাহ্য করে শুধু নিজের বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে

কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা কুরআন সম্পর্কে কোন মন্তব্য করার বিরুদ্ধে রসূলুল্লাহ স. কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন:

حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ وَكِيعٍ، حَدَّثَنَا سُوَيْدُ بْنُ عَمْرٍو الْكَلْبِيُّ، حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، عَنْ عَبْدِ الأَعْلَى، عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “‏ اتَّقُوا الْحَدِيثَ عَنِّي إِلاَّ مَا عَلِمْتُمْ فَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ وَمَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِرَأْيِهِ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ ‏.( رَوَاه التِرْمِذِىُّ فِىْ بَابِ مَا جَاءَ فِي الَّذِي يُفَسِّرُ القُرْآنَ بِرَأْيِهِ)‏

হাদীস নং- ১ : হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: তোমরা আমার থেকে নিশ্চিতভাবে না জেনে হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে সাবধান থাকবে। যে ব্যক্তি জেনে-শুনে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে সে যেন জাহান্নামে তার আবাস বানিয়ে নেয়। আর যে ব্যক্তি কুরআনে নিজের মতানুসারে কথা বলে সেও যেন তার আবাস জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। (তিরমিজী: ২৯৫১)

হাদীসটির স্তর : হাসান। ইমাম তিরমিজী রহ. বলেন: এ হাদীসটি হাসান।

সারসংক্ষেপ : এ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনুল কারীমে নিজের মতানুসারে কিছু বলার অর্থ হলো জাহান্নামের পথ অবলম্বন করা। তবে জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা গ্রহণের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসে পারদর্শী গবেষক আলিমগণ বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের ইঙ্গিত থেকে এমন ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে পারেন যা অন্য কোন আয়াত বা হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।

ইমাম তিরমিজী রহ. ২৯৫২ নম্বর হাদীসের আলোচনায় বলেন:

رُوِيَ عَنْ بَعْضِ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَغَيْرِهِمْ، أَنَّهُمْ شَدَّدُوا فِي هَذَا فِي أَنْ يُفَسَّرَ القُرْآنُ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَأَمَّا الَّذِي رُوِيَ عَنْ مُجَاهِدٍ وَقَتَادَةَ وَغَيْرِهِمَا مِنْ أَهْلِ العِلْمِ أَنَّهُمْ فَسَّرُوا القُرْآنَ فَلَيْسَ الظَّنُّ بِهِمْ أَنَّهُمْ قَالُوا فِي القُرْآنِ أَوْ فَسَّرُوهُ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَوْ مِنْ قِبَلِ أَنْفُسِهِمْ وَقَدْ رُوِيَ عَنْهُمْ مَا يَدُلُّ عَلَى مَا قُلْنَا أَنَّهُمْ لَمْ يَقُولُوا مِنْ قِبَلِ أَنْفُسِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ

অনুবাদ : সাহাবায়ে কিরাম এবং অন্যান্যদের মধ্যে যারা পারদর্শী আলিম তাদের থেকে বর্ণিত আছে যে, গভীর জ্ঞান ব্যতীত কুরআনের তাফসীর করার বিষয়ে তারা খুব কঠোরতা অবলম্বন করতেন। আর হযরত মুজাহিদ, হযরত কতাদা এবং অন্যান্যদের থেকে তাফসীর করার যে বিষয় বর্ণিত রয়েছে সে সম্পর্কে এ ধারণা করা যায় না যে, তাঁরা কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান ব্যতীত কুরআনের তাফসীর করেছেন বা কুরআন সম্পর্কে কিছু বলেছেন। বরং তাদের থেকে যা বর্ণিত আছে তা এটাই প্রমাণ করে যে, কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান ব্যতীত তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছুই বলেননি।

হযরত আমর বিন শুআইব সূত্রে তাঁর দাদা থেকে একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, إِنَّ الْقُرْآنَ لَمْ يَنْزِلْ يُكَذِّبُ بَعْضُهُ بَعْضًا، بَلْ يُصَدِّقُ بَعْضُهُ بَعْضًا، فَمَا عَرَفْتُمْ مِنْهُ، فَاعْمَلُوا بِهِ ، وَمَا جَهِلْتُمْ مِنْهُ، فَرُدُّوهُ إِلَى عَالِمِهِ  (রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেছেন:) “কুরআন এ জন্য অবতীর্ণ হয়নি যে, তার কিয়দাংশ দ্বারা অন্য অংশকে মিথ্যা প্রমাণ করা হবে। বরং কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে কিয়দাংশ দ্বারা অন্য অংশকে সত্যায়ন করার জন্য। সুতরাং যা পরিপূর্ণ অনুধাবন করতে পারো তার ওপর আমল কর। আর যে বিষয়ে তোমার অজ্ঞতা রয়েছে তা আলিমের নিকট সোপর্দ কর”। (মুসাদে আহমাদ: ৬৭০২)

এ হাদীসের তাহকীকে শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন: صحيح “হাদীসটি সহীহ”। এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, পূর্ণ অবগতি ছাড়া আমল করা বৈধ নয়। আর কুরআনের উপর আমল করা যেহেতু জরুরী তাই রসূলুল্লাহ স. আমলের জন্য আলিমের শরণাপন্ন হওয়ার তাকীদ দিয়েছেন।

কুরআন অবতরণের মূল উদ্দেশ্য মানুষের হিদায়াত। (সূরা বাকারা: ১৮৫) আর কুরআন থেকে হিদায়াত পাওয়ার নিরাপদ পদ্ধতিও এটাই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত নেক মানুষের অনুকরণে কুরআন থেকে হিদায়াত আহরণ করা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া নিজের বুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা না করা। কুরআনী ইলম শিক্ষার এ পদ্ধতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে সূরা ‘ফাতিহা’র মধ্যে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ  صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ  “হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। তাদের পথে যাদেরকে আপনি পুরস্কার দিয়েছেন; অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথে নয়”। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সীরাতে মুস্তাকীম পাওয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করে বলেন: এদের অনুসৃত পথই সীরাতে মুস্তাকীম। যার অর্থ হলো: সীরাতে মুস্তাকীম পেতে হলে পুরস্কারপ্রাপ্ত পথিকদের শরণাপন্ন হও; তাদের চলার পথই সীরাতে মুস্তাকীম। এদের পথ অনুসরণ না করে কুরআন বুঝার চেষ্টা করা ভ্রষ্টতা থেকে নিরাপদ নয়। কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে উপরোক্ত পদ্ধতি অনুকরণ না করে অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়েছে।

অন্য আয়াতে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের পচিয় এভাবে দেয়া হয়েছে যে, নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহগণ হলেন পুরস্কারপ্রাপ্ত পথিক। (সূরা নিসা: ৬৯)

সারকথা হলো: সীরাতে মুস্তাকীমের ওপর চলার জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন; আর কুরআন অনুযায়ী চলার জন্য নিজের বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল না হয়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত কোন পথিকের অনুসরণ করা চাই; যিনি কুরআন অনুযায়ী চলার পদ্ধতি শিখিয়ে দিবেন এবং দেখিয়ে দিবেন।