Save Earth

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র

১।
‘বনের পন্ডিত’ খ্যাত শিয়াল আজ বাঘের গুহার সামনে হাজির হয়েছে। সে ভাবছে বাঘ মামাকে ডাকবে নাকি! কারন সারারাত শিকার করে এখন বাঘের ঘুমানোর সময়। তবে বনের ভেতর বাঘের সাথে সবচেয়ে বেশি খাতির হলো শিয়ালেরই!! সেই সাহসেই সে এসেছে বাঘকে ডাকতে!!!
তো শিয়াল বুকে সাহস সঞ্চয় করে হাঁক দিলো, “মামা! ও মামা! জেগে আছো নাকি?”
ভেতর থেকে গমগম সরে আওয়াজ আসলো, “কে রে? কে ডাকে?”
– আমি মামা!! তোমার একমাত্র ভাগ্নে!!!
– কে? পন্ডিত নাকি?
– হ্যা মামা!! ঠিকই ধরেছো!!
– আয় ভেতরে আয়!!!
– আচ্ছা আসছি!
শিয়াল গুহার ভেতর ঢুকে দেখে বাঘের চোখ ফুলা ফুলা আর লাল হয়ে আছে। পেট টা পড়ে আছে!! সে বুঝলো বাঘ কাল রাতে কোন শিকার পায় নি!!
– মামা! কাল রাতে কিছু খেতে পাওনি তাই না?
– হ রে ভাগনে!! কি এক উজ্জ্বল আলো সারা বনের এপাশ অপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, তাই মনযোগ দিয়ে কিছুর পেছনে লাগতে পারিনি!! জানিসই তো আলোয় আমি শিকার করতে পারিনা।
– কিসের আলো মামা? আমিও কি সব উড়ো উড়ো কথা শুনছি বন নিয়া!!
– আরে বনের ধারের খাল দিয়া কি সব বড় বড় জিনিস ঘুরে বেড়ায় আর একটা আলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে বেড়ায়!! ওগুলার ভেতর মানুষ থাকে এটা জানি!!
– হ্যা!! মানুষ গুলা কেমন আজিব জানি!!! আগে তো এমন ছিল না!! হঠাৎ করে রাতে কেন তারা এসব করছে? ??
– জানিনা রে ভাগ্নে!! খুব ক্ষুধা লাগছে!
– ও হ্যা মামা!! যে কথা বলতে এখানে এসেছি!! খালের পানিতে নাকি প্রচুর মাছ ভেসে উঠেছে!! মরে মরে উঠছে!! বক ভাই এটাই আজ সকালে আমায় বলে গেলো। তোমার তো দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। তাই ভাবলাম তোমায় নিয়ে খালে যাই। গিয়ে মাছ খেয়ে আসি!!
– তাই নাকি রে? চল চল…জলদি! প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে রে!!
তারপর তারা একসাথে হাটা দেয় খালের উদ্দেশ্যে!! যেতে যেতে বাঘ বলে,
“হায়রে! কি দিন ছিলো আগে!! গরম রক্তের জীব ছাড়া কিচ্ছু খেতাম না!!! প্রচুর শিকার করতাম। আর এখন শিকারের অভাবে অখাদ্য মাছ খেতে যেতে হচ্ছে!!!
– হ মামা!! আসলেই সেই দিন গুলা আর নাই!! আর ফেরত পাবেন কিনা তা কে বলতে পারে!!
– বলিস না আর! খারাপ লাগছে রে!!!
– আচ্ছা মামা!! মন খারাপ কইরো না!!! এই তো চলে এসেছি খালে!!!
খালের কাছে গিয়ে শিয়াল আর বাঘ দুইজনই আৎকে উঠে! একি অবস্থা হয়েছে খালের!!! টলটলে সবুজ পানি কেমন কালো রুপ ধারন করেছে! দেখেই মনে হচ্ছে পানি না যেন পুরাটাই বিষ!!! ওদিকে এই পানিতেই মাছ গুলা মরে মরে ভেসে উঠছে! ভালুক খালের মোড়ের দিকটায় দাড়িয়ে মাছ ধরছে আর খাচ্ছে, বক কেউ দেখা যাচ্ছে তৃপ্তি করে মাছ খাচ্ছে!! আরও অনেক জীব কে দেখা যাচ্ছে মাছ খেতে!!
মাছের অভাব নাই চারিদিকে!! শিয়াল আর বাঘ সেগুলা খেতে শুরু করলো!! বাঘ যে কতখানি ক্ষুধার্ত তা তার নাক মুখ বুজে গোগ্রাসে খাওয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে!!!
হঠাৎ করেই কান খাড়া করলো বাঘ!! কিসের যেন শব্দ শুনা যাচ্ছে!! আস্তে আস্তে শব্দ বাড়ছে!! এবং এদিকেই আসছে!! অন্যান্য সব জীব ছুটে বনের ভেতর ঢুকে পরলো, বাঘ আর শিয়ালও একটা ঝোপের আড়ালে বসে গেলো!!

তারা অবাক চোখে দেখলো একটা বিরাট নৌকার মতন কিজানি খালের পানি দিয়ে যাচ্ছে!! নৌকার ভেতর কালো কালো কিজানি !!! এভাবেই শব্দ করে জিনিস টা চোখের আড়াল হয়ে গেলো!!!
.
২।
বনের অবস্থা খুবই খারাপ!! গাছপালা গুলা কেমন জানি শুকিয়ে যাচ্ছে!! বানর গুলো বন থেকে এক এক করে দুরে কোথায় জানি চলে যাচ্ছে!! বঁক আর হাস গুলা স্থায়ী ভাবে খালে বাসা বেধেছে!! কেমন রুক্ষ রুক্ষ ভাব!! বাতাস কেমন জানি হালকা আর তিতা লাগে শিয়ালের!! বুক ভরে শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হয়!!!
সে এসেছে বনের সব চেয়ে প্রাচীন জীব পেঁচার কাছে!!! চারিদিকে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে ধারনা নিতে!! তো শিয়াল দেখলো পেঁচাও বোঁচকা বেধে নিয়ে বের হচ্ছে!!
– দাদামশাই! এমন বোঁচকা বেধে কই যান?
– বন ছেড়ে দিচ্ছি রে পন্ডিত!!!
– আজিব! কি বলেন? আপনার পুরা বংশই তো এই বুড়া গাছে থেকে এসেছে!!! এভাবে চলে যাচ্ছেন কেন?
– সামনে ঘোর বিপদ আসছে রে!! আমি ঠিক বুঝতে পারছি!!! এসব যা দেখছিস কিচ্ছু থাকবে না!!! সব ধ্বংস হয়ে যাবে রে!! আমি আর এখানে থাকবো না!! তুই ও চলে যা!!
– মানে? কি বলছেন দাদামশাই? কিছু কি বুঝতে পারছেন?
– বুঝতে না পারলে এমনি বলছি? সেদিন উত্তরে গেছিলাম। গিয়ে দেখি ইয়া বড় বড় থাম!! ওগুলার নিচে কালো কালো কি জানি ঢুকিয়ে দিচ্ছে আর থাম গুলার উপর থেকে কালো কালো বিষ বের হয়ে বাতাসে মিশছে!!! এই বাতাস আর সেই বাতাস নেই রে!!! আমি আর থাকবো না!!
– তাই নাকি? নিশ্চই মানুষ এসব করছে তাই না?
– মানুষ ছাড়া আর কে করবে? থাক আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!! পশ্চিমে যাবো!! বহু পথ পাড়ি দিতে হবে!!!
শিয়াল তখন পেঁচাকে বিদায় জানায়। ওর খুব কৌতুহল হচ্ছে কিসের কি হচ্ছে উত্তরে!!! মানুষ গুলা কি করছে জানা দরকার!! সে সিদ্ধান্ত নিলো একদিন গিয়ে দেখে আসবে!! তার আগে ওর বাঘের কাছে যাওয়া দরকার!! শুনেছে বাঘ মামা নাকি অসুস্থ!!!
.
৩।
শিয়াল খুবই অসুস্থ!!! একটু পরপরই কাঁশছে!!! বহুদিন নিজের গুহায় পড়ে ছিল!! বাইরে বের হয় নি!!! প্রচন্ড ক্ষুধাও লাগছে!! জমিয়ে রাখা মাছ গুলাও শেষ!! বাঘ মামার অসুখ ভাল হয়েছে কিনা কে জানে!!! সে গুহা থেকে বের হলো!!!
দুর্বল শরীরে বের হয়ে পুরাই অবাক হয়ে গেলো!! এ সে কোথায় দাড়িয়ে আছে!!! একটা গাছেও পাতা নাই। সব শুকিয়ে কাঠ!! কোন পশুপাখির আওয়াজ নাই!!! কেমন গা ছমছমে নিরবতা!! শিয়ালের মাথা ঘুরছে! ! চোখ ফেটে কান্না আসছে!! কি অবস্থা তার প্রিয় বাসভূমির!!!
প্রচন্ড ক্ষুধার তারনায় সে খালের ধারে গেলো!!! কিন্তু একি!!! পুরা খাল কুটকুটে কালো পানিতে ভর্তি! ! অনেক মাছ পঁচে মরে আছে!!! আশে পাশে অনেক বকও মরে আছে!!! অনেকের মুখে মাছ!! তারমানে কি মাছ গুলাও বিষাক্ত?? কিন্তু কোন জীবিত বক বা হাঁস দেখা যাচ্ছে না!!! কই গেলো সব!!! সে মাছ গুলা মুখে তুলতে সাহস পেল না। হয়তো বিষাক্ত।
সে বাঘের গুহার দিকে যেতে লাগলো ! হয়তবা মামার কাছে কিছু খাবার পাওয়া যাবে! !! গুহার সামনে গিয়ে কিছুক্ষন ডাকাডাকি করলো!! কিন্তু কোন আওয়াজ নাই!!! কেমন জানি বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে গুহা থেকে!!! বুকের ভেতর তা ছ্যাৎ করে উঠল শিয়ালের। সে গুহায় ঢুকলো!!!
ঢুকেই কিছুক্ষন নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকলো!! সামনে পড়ে আছে হাড় বের হওয়া বাঘের মৃত শরীর! আশে পাশে পঁচা মাছ ছড়িয়ে পরে আছে!!! শিয়াল এত বড় ধাক্কা সহ্য করতে পারলো না!!! কেঁদে উঠলো!! বনে বাঘের সাথেই ওর খাতির ছিল বেশি!!! সেই বাঘ আজ আর কথা বলবে না!! আহাজারি করে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে শিয়াল সেখানেই ঘুমিয়ে পরলো!



ঘুম ভাঙলে শিয়াল বুঝলো রাক্ষসের ক্ষুধা লাগছে পেটে!! মাথা বন বন করে ঘুরছে! !! এখন খাবার না পেলে মারা যাবে সে!!! শরীর খুব দুর্বল। হাটারও শক্তি নেই!! বাঘের গুহাতেই ঘুমিয়ে পরেছিল তা মনে পরলো শিয়ালের! ! পাশেই পরে আছে বাঘের দেহ!!! ক্ষুধার চোটে সম্পর্কের কথা অতীতের কথা ভুলে গেলো শিয়াল!!! বুভুক্ষুর মত কামড়ে খেতে লাগলো মৃত বাঘের দেহ!!!
বাঘের মাংস খেয়ে এখন কিছুটা সুস্থ অনুভব করছে শিয়াল! ! মন স্থির হওয়ায় বুঝতে পারলো কি জঘন্য কাজ করে ফেলেছে সে!! কিন্তু এটা বলে সে মনকে বুঝ দিলো যে ক্ষুধার কাছে সব ন্যায়!!
গুহা থেকে বের হলো সে!!! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে কই যাবে!! উত্তরের দিকে হাটা দিল শিয়াল!!! যেখানে পেঁচা বড় বড় থাম দেখে এসেছে!!!
পুরা একদিন হেটে খুব ক্লান্ত শিয়াল। কিন্তু ওর ভেতর টা জ্বলে যাচ্ছে কেমন যেন!! বুকটা কেমন ধরফর করছে!! শিয়ালের বুকটা আৎকে উঠলো একটা কথা ভেবে!! যে বাঘের শরীরে বিষক্রিয়া ছিল না তো? সেই বিষ মাংস সে খায় নি তো!!!
যত সময় যাচ্ছে তত বুকের জ্বালাপোড়া বাড়ছে শিয়ালের!!! সে বুঝে গেছে বিষ খেয়েছে!! এগুলা বিষেরই প্রতিক্রিয়া। সে দ্রুত পথ চলেছে! উদ্দেশ্য উত্তর!!! সে মরার আগে একবার হলেও তার জন্মভূমি ধ্বংসের শত্রু কে দেখে যাবে!! তার সময় ফুরিয়ে আসছে!! অইতো সামনে কেমন জানি একটা শব্দ শুনা যায়!!! শব্দের উৎস লক্ষ করে সে এগিয়ে চললো!!!
বুকের ভেতরটায় এখন যেন আগুন ধরে গেছে শিয়ালের! ! নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। মুখ দিয়ে লালা বের হয়ে পরে যাচ্ছে!!! পা আর চলতে চাইছে না!!! তবুও সে এগিয়ে চলছে! ! সামনের ফাঁকা যায়গায় বের হয়ে পরলো সে!! চোখের সামনেই বের হয়ে পরলো বিরাট একটা থামের মত কি জানি!!!
শিয়ালের হাটার শক্তি শেষ!!! সে সেখানেই ধপ করে বসে পরলো! নিশ্বাস আটকে গেছে ওর। ভেতরে বাতাস ঢুকছে না!! সে পিটপিট করে চেয়ে দেখলো বিশাল থামের নিচ দিয়ে খালের নৌকায় করে আনা কালো কালো বস্তু গুলা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে আর থামের উপর দিয়ে কালো ধোয়া বের হয়ে যাচ্ছে!!! দুরের কিছু মানুষকে দেখা যাচ্ছে হাসি হাসি মুখ!!!
শিয়াল পন্ডিত এতটুকু দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেললো!!! আস্তে আস্তে মনে পরে গেলো সুন্দর শ্যামল বনটার কথা, বনের পশুপাখির কথা, তাদের আনন্দ ফুর্তির কথা, কত মায়া মমতা ছিল বনটাকে ঘিরে!! সেই বন আজ নেই, পশু পাখিও নেই!!! চোখের কোন দিয়ে এক ফোটা জল বের হয়ে গাল বেয়ে নামতে লাগলো শিয়ালের! ! জল মাটিতে পরার আগেই তার প্রানটা বের হয়ে কালো বাতাসের সাথে মিশে গেলো!!! দুর থেকে দুরে এই দুষিত পরিবেশ থেকে দুর আকাশে মিলিয়ে গেলো!!!
.
শিয়াল যদি পড়ালেখা জানতো তাহলে সে মরার আগে দেখে যেতে পারতো তার আর তাদের জীববৈচিত্র ধ্বংসের পেছনে থাকা শত্রুর নাম!! জানতে পারতো কি তাদের সাজানো বনের শ্যামল ছবি টাকে এভাবে চিরতরে মুছে দিলো!!! কারন থামগুলার গায়েই বড় বড় করে লিখা ছিল, “রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র!!!”
——–
collected

image